নেত্রকোনা ০১:৪৬ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

গ্রাম আদালত আইনটি যুগোপযুগী করে সংশোধন করা এখন সময়ের দাবী

  • আপডেট : ০৮:২৩:৪৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ১২ অক্টোবর ২০১৯
  • ৬৬০

নিকোলাস বিশ্বাস : দেশের উচ্চতর আদালতগুলো বিচারাধীন লক্ষ লক্ষ মামলার চাপে ভারাক্রান্ত। এ মতাবস্থায়, প্রান্তিক মানুষের পক্ষে আইনের আশ্রয় লাভ করা খুবই কঠিন হয়ে উঠেছে। প্রতিদিনই উচ্চতর আদালতগুলোতে মামলার অপরিসীম চাপ বাড়ছে। বর্তমানে উচ্চতর আদালতগুলোতে ৩৫ লক্ষাধিক মামলা বিচারাধীন। আজ থেকে উচ্চতর আদালতগুলোতে যদি আর কোন নতুন মামলা দায়ের করা না হয় তবুও আদালতগুলোতে বিচারাধীন মামলাগুলো নিস্পত্তি করতে কয়েক দশক সময় লাগবে। উচ্চতর আদালতগুলোর এই নাজুক পরিস্থিতিতে দেশের প্রতিটি ইউনিয়নের গ্রাম আদালতগুলো স্থানীয়ভাবে আইনি-সেবা নিশ্চিতকরণে ব্যাপক ভূমিকা পালন করতে পারে।

গ্রাম আদালত আইন ২০০৬ অনুযায়ী প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদে গ্রাম আদালত থাকলেও যথাযথ আইন মেনে বিচার-কার্য সর্বত্র পরিচালিত হয় না। আবার যেখানে আইন মেনে বিচারিক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে সেখানেও আইনের কিছু দুর্বলতার কারণে গ্রাম আদালতে কাঙ্খিত ফলাফল আসছে না। গ্রাম আদালত আইন ২০০৬ (সংশোধন ২০১৩) -এর দুর্বলতার কিছু দিক নিয়ে এখানে আলোচনা করা হল।

প্রথমতঃ গ্রাম আদালতের আর্থিক এখতিয়ার যা বর্তমানে মাত্র ৭৫,০০০ টাকা অর্থ্যাৎ গ্রাম আদালত ৭৫,০০০ টাকার উপরে কোন রায় দিতে পারবে না। এখনকার বাজার-দর বিবেচনায় গ্রাম আদালতের আর্থিক এখতিয়ার বাড়িয়ে কমপক্ষে ২০০,০০০ টাকা করা দরকার। পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে যে, গ্রাম আদালতে জমি-জমা সংক্রান্ত দেওয়ানী মামলাই দায়ের হয় বেশী কিন্তু গ্রাম আদালতের আর্থিক এখতিয়ার কম থাকায় এ মামলাগুলো গ্রাম আদালতে নথিভূক্ত করা যাচ্ছে না। এজন্য সাধারণ মানুষ আইন বহির্ভূত গ্রাম্য-সালিশের দিকেই ঝুকে পড়ছে। আবার আর্থিক সংকটের কারণে তাদের অনেকেই উচ্চতর আদালতে যেতে পারছে না। ফলে সাধারণ মানুষ আইনি সুবিধা হতে বঞ্চিত হচ্ছেন।

দ্বিতীয়তঃ আদালত থেকে মামলার প্রতিপক্ষের প্রতি সমন জারীর পর যদি প্রতিপক্ষ আদালতে না আসে তাহলে মামলার আবেদনকারীকে ডেকে মামলাটি ফেরত দেওয়া ছাড়া গ্রাম আদালতের হাতে আর কিছুই করার নেই। এ ক্ষেত্রে যিনি মামলাটি দায়ের করলেন তিনি আইনের আশ্রয় হতে বঞ্চিত হলেন। গ্রাম আদালত কার্যকর করার স্বার্থে এখানে আদালতের হাতে অবশ্যই কিছু আইনগত করণীয় থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে যা করা যেতে পারে তাহল উক্ত মামলাটি সরাসরি উচ্চতর আদালতে রেফার করার ক্ষমতা গ্রাম আদালতকে দেওয়া যায় যাতে মানুষ গ্রাম আদালতের প্রতি অনুগত হয় এবং আদালতের কাজে সহযোগিতা করে। বিষয়টির গভীরে আরো পর্যালোচনা হতে পারে এবং সম্ভাব্য আরো অপশন নিয়ে ভাবা যায় যাতে গ্রাম আদালত কার্যকরভাবে বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে এবং মানুষের সেবা করতে পারে।

তৃতীয়তঃ মামলার অতি নগন্য ফি। গ্রাম আদালত আইন ২০০৬ (সংশোধন ২০১৩) অনুযায়ী বর্তমানে ফৌজদারী মামলা দায়েরের জন্য ১০ টাকা এবং দেওয়ানী মামলা দায়েরের জন্য ২০ টাকা ফি প্রদানের ব্যবস্থা রয়েছে। আজকাল ১০ টাকা বা ২০ টাকা খুব বেশী কিছু নয়। জেলা পর্যায়ের হোটেলেগুলোতে এখন এক কাপ দুধ চায়ের দামই ১৫ টাকা। সুতরাং এই নগন্য ফিসের পরিমাণের উপর বিচারপ্রার্থীদের আস্থা কতটুকু সৃষ্টি হয় তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। অথচ এই সুযোগে কোন কোন গ্রাম আদালতে বিচারপ্রার্থীদের কাছ থেকে নানা অজুহাতে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করা হয় যার কোন হিসেব নেই কারণ এগুলো বৈধ নয়। অনেককে বলতেই শোনা যায় যে, মাত্র ১০ টাকা বা ২০ টাকা দিয়ে কি-ইবা বিচার পাবো! এ অবস্থার পরিবর্তনের জন্য গ্রাম আদালতে মামলা দায়েরের ফি কমপক্ষে ২০০ টাকা নির্ধারণ করা দরকার। উপরন্তু জটিলতা কমানোর জন্য উভয় মামলার ক্ষেত্রে (ফৌজদারী ও দেওয়ানী) একই পরিমাণ ফি রাখা উচিৎ। এটা করতে পারলে নানা অজুহাতে অর্থ আদায়ের অবৈধ পন্থাগুলো বন্ধ হবে এবং আদায়কৃত অর্থের সঠিক হিসাব আদালতে সংরক্ষিত থাকবে। এরফলে গ্রাম আদালতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে।

গ্রাম আদালত সক্রিয়করণের আরেকটি বড় সমস্যা হল পুলিশ থানাগুলোর গোলঘর; কারণ সেখানে গ্রাম আদালতের এখতিয়ারাধীন মামলাগুলো অবলীলায় বিচার-সালিশ হয়ে যাচ্ছে যা কাঙ্খিত নয়। যদি এমন আইন করা হোত যে, থানায় গ্রাম আদালতের কোন মামলা গেলে তারা সেখান থেকে মামলাগুলো সরাসরি গ্রাম আদালতে রেফার করে দিবেন যেভাবে উচ্চ আদালত হতে গ্রাম আদালতে মামলা রেফার করা হয়। এতে নিশ্চিতভাবে গ্রাম আদালত প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাবে এবং এর উপর মানুষের আস্থা বাড়বে।।  

আপনার মন্তব্য লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষণ করুন

প্রকাশক ও সম্পাদক সম্পর্কে-

আমি মো. শফিকুল আলম শাহীন। আমি একজন ওয়েব ডেভেলপার ও সাংবাদিক । আমি পূর্বকণ্ঠ অনলাইন প্রকাশনার সম্পাদক ও প্রকাশক। আমি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইতিবাচক। আমি করতে, দেখতে এবং অভিজ্ঞতা করতে পছন্দ করি এমন অনেক কিছু আছে। আমি আইটি সেক্টর নিয়ে বিভিন্ন এক্সপেরিমেন্ট করতে পছন্দ করি। যেমন ওয়েব পেজ তৈরি করা, বিভিন্ন অ্যাপ তৈরি করা, অনলাইন রেডিও স্টেশন তৈরি করা, অনলাইন সংবাদপত্র তৈরি করা ইত্যাদি। আমাদের প্রকাশনা “পূর্বকন্ঠ” স্বাধীনতার চেতনায় একটি নিরপেক্ষ জাতীয় অনলাইন । পাঠক আমাদের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরনা। পূর্বকণ্ঠ কথা বলে বাঙালির আত্মপ্রত্যয়ী আহ্বান ও ত্যাগে অর্জিত স্বাধীনতার। কথা বলে স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হতে। ছড়িয়ে দিতে এ চেতনা দেশের প্রত্যেক কোণে কোণে। আমরা রাষ্ট্রের আইন কানুন, রীতিনীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল। দেশপ্রেম ও রাষ্ট্রীয় আইন বিরোধী এবং বাঙ্গালীর আবহমান কালের সামাজিক সহনশীলতার বিপক্ষে পূর্বকন্ঠ কখনো সংবাদ প্রকাশ করে না। আমরা সকল ধর্মমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, কোন ধর্মমত বা তাদের অনুসারীদের অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে আমরা কিছু প্রকাশ করি না। আমাদের সকল প্রচেষ্টা পাঠকের সংবাদ চাহিদাকে কেন্দ্র করে। তাই পাঠকের যে কোনো মতামত আমরা সাদরে গ্রহন করব।
জনপ্রিয়

পূর্বধলায় বণিক সমিতির সাথে উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীর মতবিনিময়

গ্রাম আদালত আইনটি যুগোপযুগী করে সংশোধন করা এখন সময়ের দাবী

আপডেট : ০৮:২৩:৪৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ১২ অক্টোবর ২০১৯

নিকোলাস বিশ্বাস : দেশের উচ্চতর আদালতগুলো বিচারাধীন লক্ষ লক্ষ মামলার চাপে ভারাক্রান্ত। এ মতাবস্থায়, প্রান্তিক মানুষের পক্ষে আইনের আশ্রয় লাভ করা খুবই কঠিন হয়ে উঠেছে। প্রতিদিনই উচ্চতর আদালতগুলোতে মামলার অপরিসীম চাপ বাড়ছে। বর্তমানে উচ্চতর আদালতগুলোতে ৩৫ লক্ষাধিক মামলা বিচারাধীন। আজ থেকে উচ্চতর আদালতগুলোতে যদি আর কোন নতুন মামলা দায়ের করা না হয় তবুও আদালতগুলোতে বিচারাধীন মামলাগুলো নিস্পত্তি করতে কয়েক দশক সময় লাগবে। উচ্চতর আদালতগুলোর এই নাজুক পরিস্থিতিতে দেশের প্রতিটি ইউনিয়নের গ্রাম আদালতগুলো স্থানীয়ভাবে আইনি-সেবা নিশ্চিতকরণে ব্যাপক ভূমিকা পালন করতে পারে।

গ্রাম আদালত আইন ২০০৬ অনুযায়ী প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদে গ্রাম আদালত থাকলেও যথাযথ আইন মেনে বিচার-কার্য সর্বত্র পরিচালিত হয় না। আবার যেখানে আইন মেনে বিচারিক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে সেখানেও আইনের কিছু দুর্বলতার কারণে গ্রাম আদালতে কাঙ্খিত ফলাফল আসছে না। গ্রাম আদালত আইন ২০০৬ (সংশোধন ২০১৩) -এর দুর্বলতার কিছু দিক নিয়ে এখানে আলোচনা করা হল।

প্রথমতঃ গ্রাম আদালতের আর্থিক এখতিয়ার যা বর্তমানে মাত্র ৭৫,০০০ টাকা অর্থ্যাৎ গ্রাম আদালত ৭৫,০০০ টাকার উপরে কোন রায় দিতে পারবে না। এখনকার বাজার-দর বিবেচনায় গ্রাম আদালতের আর্থিক এখতিয়ার বাড়িয়ে কমপক্ষে ২০০,০০০ টাকা করা দরকার। পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে যে, গ্রাম আদালতে জমি-জমা সংক্রান্ত দেওয়ানী মামলাই দায়ের হয় বেশী কিন্তু গ্রাম আদালতের আর্থিক এখতিয়ার কম থাকায় এ মামলাগুলো গ্রাম আদালতে নথিভূক্ত করা যাচ্ছে না। এজন্য সাধারণ মানুষ আইন বহির্ভূত গ্রাম্য-সালিশের দিকেই ঝুকে পড়ছে। আবার আর্থিক সংকটের কারণে তাদের অনেকেই উচ্চতর আদালতে যেতে পারছে না। ফলে সাধারণ মানুষ আইনি সুবিধা হতে বঞ্চিত হচ্ছেন।

দ্বিতীয়তঃ আদালত থেকে মামলার প্রতিপক্ষের প্রতি সমন জারীর পর যদি প্রতিপক্ষ আদালতে না আসে তাহলে মামলার আবেদনকারীকে ডেকে মামলাটি ফেরত দেওয়া ছাড়া গ্রাম আদালতের হাতে আর কিছুই করার নেই। এ ক্ষেত্রে যিনি মামলাটি দায়ের করলেন তিনি আইনের আশ্রয় হতে বঞ্চিত হলেন। গ্রাম আদালত কার্যকর করার স্বার্থে এখানে আদালতের হাতে অবশ্যই কিছু আইনগত করণীয় থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে যা করা যেতে পারে তাহল উক্ত মামলাটি সরাসরি উচ্চতর আদালতে রেফার করার ক্ষমতা গ্রাম আদালতকে দেওয়া যায় যাতে মানুষ গ্রাম আদালতের প্রতি অনুগত হয় এবং আদালতের কাজে সহযোগিতা করে। বিষয়টির গভীরে আরো পর্যালোচনা হতে পারে এবং সম্ভাব্য আরো অপশন নিয়ে ভাবা যায় যাতে গ্রাম আদালত কার্যকরভাবে বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে এবং মানুষের সেবা করতে পারে।

তৃতীয়তঃ মামলার অতি নগন্য ফি। গ্রাম আদালত আইন ২০০৬ (সংশোধন ২০১৩) অনুযায়ী বর্তমানে ফৌজদারী মামলা দায়েরের জন্য ১০ টাকা এবং দেওয়ানী মামলা দায়েরের জন্য ২০ টাকা ফি প্রদানের ব্যবস্থা রয়েছে। আজকাল ১০ টাকা বা ২০ টাকা খুব বেশী কিছু নয়। জেলা পর্যায়ের হোটেলেগুলোতে এখন এক কাপ দুধ চায়ের দামই ১৫ টাকা। সুতরাং এই নগন্য ফিসের পরিমাণের উপর বিচারপ্রার্থীদের আস্থা কতটুকু সৃষ্টি হয় তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। অথচ এই সুযোগে কোন কোন গ্রাম আদালতে বিচারপ্রার্থীদের কাছ থেকে নানা অজুহাতে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করা হয় যার কোন হিসেব নেই কারণ এগুলো বৈধ নয়। অনেককে বলতেই শোনা যায় যে, মাত্র ১০ টাকা বা ২০ টাকা দিয়ে কি-ইবা বিচার পাবো! এ অবস্থার পরিবর্তনের জন্য গ্রাম আদালতে মামলা দায়েরের ফি কমপক্ষে ২০০ টাকা নির্ধারণ করা দরকার। উপরন্তু জটিলতা কমানোর জন্য উভয় মামলার ক্ষেত্রে (ফৌজদারী ও দেওয়ানী) একই পরিমাণ ফি রাখা উচিৎ। এটা করতে পারলে নানা অজুহাতে অর্থ আদায়ের অবৈধ পন্থাগুলো বন্ধ হবে এবং আদায়কৃত অর্থের সঠিক হিসাব আদালতে সংরক্ষিত থাকবে। এরফলে গ্রাম আদালতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে।

গ্রাম আদালত সক্রিয়করণের আরেকটি বড় সমস্যা হল পুলিশ থানাগুলোর গোলঘর; কারণ সেখানে গ্রাম আদালতের এখতিয়ারাধীন মামলাগুলো অবলীলায় বিচার-সালিশ হয়ে যাচ্ছে যা কাঙ্খিত নয়। যদি এমন আইন করা হোত যে, থানায় গ্রাম আদালতের কোন মামলা গেলে তারা সেখান থেকে মামলাগুলো সরাসরি গ্রাম আদালতে রেফার করে দিবেন যেভাবে উচ্চ আদালত হতে গ্রাম আদালতে মামলা রেফার করা হয়। এতে নিশ্চিতভাবে গ্রাম আদালত প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাবে এবং এর উপর মানুষের আস্থা বাড়বে।।