মেহেদী হাসান, রাবি সংবাদদাতা:
প্রশাসনের সঠিক নজরদারির অভাব, ক্যাম্পাসের বিভিন্ন পয়েন্টে আলোর স্বল্পতা ও প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যরা যথাযথ দায়িত্ব পালন না করায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) বেড়েই চলেছে ছিনতাইকারী ও বহিরাগতদের দৌরাত্ম। ক্যাম্পাসে অহরহ ঘটছে ছিনতাইয়ের ঘটনা। এছাড়া খেলার মাঠ দখল, ছাত্রী উত্যক্ত, মাদক ব্যবসা, বিভিন্ন স্পটে মাদকসেবীদের আখড়া হিসেবে গড়ে তোলা, বেপরোয়া গতিতে ক্যাম্পাসে মটরবাইক চালানোসহ বহিরাগত কর্তৃক নানা অপকর্ম সংগঠিত হচ্ছে। ফলে বহিরাগতদের এমন কর্মকাÐে শিক্ষাক-শিক্ষার্থীরা জিম্মি হয়ে পড়লেও কার্যত কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ১৫ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টেডিয়ামের পেছনে মাদার বক্স হলের পুকুরসংলগ্ন রাস্তায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনফরমেশন অ্যান্ড লাইব্রেরি ম্যানেজমেন্টের দ্বিতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থীকে ছুরিকাঘাত করে ছিনতাই করেছে দুর্বৃত্তরা। এর আগে গত ১৮ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন গেইটের সামনে সংস্কৃত বিভাগের এক ছাত্রী ছিনতাইয়ের শিকার হন। এছাড়া ২৮ ফেব্রæয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু একাডেমিক ভবনের পিছনে সমাজকর্ম বিভাগের এক শিক্ষার্থীর মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে মোবাইল ও টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। সর্বশেষ গত শুক্রবার (১৮ অক্টোবর) বিশ্ববিদ্যালয়ের হবিবুর রহমান হলের মাঠে ছিনতাইকারীর হাতুড়িপেটায় আহত হন অর্থনীতি ্িবভাগের এক শিক্ষার্থী। এসব ঘটনায় বহিরাগতসহ রাবি শাখা ছাত্রলীগের বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী জড়িত বলে জানা গেছে।
পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, রাবি সংলগ্ন কাজলা, মেহেরচন্ডী, বিনোদপুর, বুধপাড়া ও আশেপাশের এলাকা থেকে বহিরাগতরা হরহামেশাই ঢুকছে ক্যম্পাসে। এতে করে বিশ^বিদ্যালয়ের টুকিটাকি চত্বর, জোহা চত্বর, পশ্চিম পাড়া, পরিবহন মার্কেট, পুরাতন ফোকলোর চত্বর, মমতাজ উদ্দিন কলা ভবনের পিছনে, বধ্যভ‚মি, সোহরাওয়ার্দী হল সংলগ্ন পুকুর পাড় ও মাদার বখ্শ হল সংলগ্ন দিপুর দোকানে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বহিরাগতদের সরব উপস্থিতি। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবন এলাকা ও পশ্চিম পাড়া শিক্ষকদের আবাসিক এলাকায় বহিরাগত প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও সেখানেও তারা অবাধে প্রবেশ করে ঘটিয়ে চলেছে নানা অপকর্র্ম। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য যেসব খেলার মাঠ রয়েছে সেগুলোও থাকছে বহিরাগতদের দখলে।
এছাড়া ক্লাস-পরীক্ষা চলাকালীন একাডেমিক ভবনের সামনে এসে উচ্চস্বরে হর্ণ বাজিয়ে বেপরোয়া গতিতে বাইক চালায় বহিরাগতরা। ফলে চলাচলে চরম বিড়ম্বনায় পড়তে হয় শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের। এসব মোটর চালকদের দ্বারা ছাত্রী উত্যক্তের ঘটনা রুটিন মাফিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এসব অপকর্মের প্রতিবাদ করলে বিভিন্নভাবে তাদের হাতে লাঞ্ছিত হতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের।
আরও জানা যায়, পুরাতন ফোকলোর চত্বর থেকে প্রকাশ্যে মাদক সেবনরত অবস্থায় গত ২০ জুলাই তিনজন বহিরাগত, গত ১৮ সেপ্টেম্বর দুইজন বহিরাগতসহ তিনজনকে এবং গত ২৫ জুলাই সাবাশ বাংলাদেশে মাঠ থেকে দুই বহিরাগত আটক করে জেলহাজতে পাঠায় পুলিশ। এছাড়া গত ২২ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবন এলাকায় আপত্তিকর কাজে লিপ্ত থাকার অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীসহ বহিরাগত ৫ প্রেমিক যুগলকে আটক করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর।
এ বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে রাবির একাধিক শিক্ষক বলেন, শিক্ষকদের আবাসিক এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কর্তৃক বহিরাগত ও শিক্ষার্থীদের প্রবেশের নিষেধাজ্ঞা জারি আছে। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে অহরহ যাতায়াত করছে, সংগঠিত হচ্ছে নানা অপকর্ম। বিভিন্ন সময় এই এলাকায় আসা প্রেমিক যুগলকে আপত্তিকর অবস্থায় দেখা যায়। ফলে বিকেলে আমাদের সন্তানদের নিয়ে ঘুরতে বের হতে পারিনা বা বের হলেও বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয় আমাদের।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দ ও বিশ^বিদ্যালয়ের ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের ছত্রছায়ায় তারা এসব অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে বহিরাগতরা। আর বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসনের নমনীয় অবস্থানের কারণে নিজ ক্যাম্পাসে স্থানীয় বখাটেদের কাছে শিক্ষার্থীরা জিম্মি হয়ে পড়েছে।
বিশ^বিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের ইমতিয়াজ নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমরা বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ্যালয়টি আমাদের তাও বহিরাগতাদের উৎপাতে ক্যাম্পাসে নিরাপদভাবে চলতে পারিনা। খেলার মাঠে খেলতে গেলে তাদের সাথে শিক্ষার্থীদের প্রায়ই দ্ব›দ্ব হয়। কিছু বলতে গেলে পরে দেখে নেওয়ার হুমকি দেয়। বহিরাগতরা ক্যাম্পাসে এভাবে অপকর্ম করে বেড়ালেও তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ক্যাম্পাসে যে চুরি-ছিনতাইগুলো হয় তার অধিকাংশই করে বহিরাগতরা। এছাড়া দিনের বেলা এবং সন্ধ্যায় তারা ক্যাম্পাসে দ্রæত গতিতে মোটরসাইকেল চালায়। তাদের এ অনিয়ন্ত্রিত মোটরসাইকেল চালনা আমাদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করে।’
ফাতেমা নামের এক ছাত্রী বলেন, ‘মেয়েদের হলের সামনে প্রায়ই দলবেঁধে বহিরাগতদের ঘুরতে দেখা যায়। বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত তারা হলগুলোর সামনে গিয়ে জোরে মোটর সাইকেল চালায় এবং ঘন ঘন হর্ণ দিতে থাকে। এছাড়া সন্ধ্যার পর ক্যাম্পাসে চলতে গেলে তারা দূর থেকে আজেবাজে মন্তব্য করে। প্রতিবাদ করতে গেলে উল্টো লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়।’
জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক লুৎফর রহমান বলেন, বহিরাগতদের ঠেকাতে মাঝে মাঝে ক্যাম্পাসে অভিযান চালিয়ে থাকি। প্রয়োজনে আবার অভিযান চালাবো। কেউ যদি ক্যাম্পাসের স্বাভাবিক পরিবেশে বিঘœ ঘটায় তাহলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।