
চিরায়ত বাংলার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে নস্যাৎ করার ষড়যন্ত্র এটিই নতুন নয়-উপনিবেশিক শাসনামলে বৃটিশ, পাকিস্তানি শাসনামলে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী, শাসনের নামে শোষনের ভুমিকায় নিজেদেরকে অপ্রতিরোধ্য করতে বাঙ্গালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে মুছে দিয়ে বাংলাকে দাসত্বে রুপান্তরিত করার ঘৃন্য চেষ্টায় লিপ্ত ছিলো প্রতিনিয়ত।
কিন্তু বাংলা আর বাঙালি তার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে সমুন্নত রাখতে আমরন সংগ্রাম করে জিতেছে বারবার। প্রাচীন কাল থেকে শুরু করে পাল,সেন,সুলতানি, মোঘল,বৃটিশ,এমনকি পাকিস্তানি শাসনামলেও এই অঞ্চলের যে সমস্ত নান্দনিক ভাস্কর্যের সৃষ্টিশীল চিন্তার বিকাশ বাংলার ঐতিহ্যকে বহন করে নিয়ে আসছে সেগুলো নিয়ে কোন প্রশ্ন উঠেনি কখনো।
এই বাংলায় অনেক পর্যটক,সূফী-সাধকের আগমন ঘটেছে কিন্তু কেউ কি এই সমস্ত নান্দনিক সৃজনশীল চিন্তাকে নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন ?
প্রাচীন কাল থেকে প্রতিষ্টিত ভাস্কর্যের যাত্রা কি আজকের হুংকারের পূর্ব পর্যন্ত বন্ধ ছিলো ? নাহ্ – বন্ধ ছিলো না, বরং বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় নান্দনিক ভাস্কর্যের প্রবাহমান ধারা অব্যাহত ছিলো। তাহলে কথিত আজকের আলেম সমাজ স্বাধীন বাংলার স্থপতি বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যকে অপসারনের ঘোষণা দিয়ে নতুন অধ্যায়ের মাত্রা যোগ করলো।
যাদের হুংকারে বাংলা নির্বাক- তারা সৌদি আরব সহ মধ্য প্রাচ্যের কোন দেশের দৃষ্টান্তকে গ্রহন না করে কোরআন ও হাদিসের কথা বলে মাঠে ধোয়া তুলছেন–কিন্তু ইসলামের পুন্যভূমি হিসাবে পরিচিত, সারা মুসলিম জগত যেখানে হজ্ব পালনে ছুটে আসে-নবীজি যেখানে জন্মেছেন, যেখানে নবুয়ত পেয়েছেন,যেখানে বিদায় হজ্জের ভাষন দিয়েছেন,ইসলাম যেখানে পুর্নতা লাভ করেছিলো –সেই পুন্যভূমি সৌদি আরবকে দৃষ্টান্ত হিসাবে না মেনে তারা বাংলাদেশকে কি বুঝাতে চাচ্ছেন -?
এটি বাংলার মানুষ এখন বুঝতে শিখেছে – মনে রাখা উচিত, বাংলাদেশে এখনো মসজিদ থেকে সমুধুর আজানের ধ্বনিই ভেসে আসছে, এই দেশ এখনো একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশই আছে ৷ শুধু প্রকৃতির আবহ থেকে বিতারিত হয়েছে তারা – যারা মিথ্যা বলে দেশকে অস্হীতিশীল করেছিলো।
প্রমানীত হয়েছে মুসলমান অধ্যুষিত বাংলাদেশ আজও ধর্মীয় আলেমদের সম্মান দিয়ে,মসজিদ এবং মাদ্রাসার ব্যাপক উন্নয়ন মুলক কর্মকান্ড সম্পাদন করে যাচ্ছে। যুগে যুগে এখানে আলেমের অবস্থান বিদ্যমান থাকা সত্যেও-পুর্বের নির্মিত কোন ভাস্কর্যকে মূর্তি বলে অপসারণের হুংকার তোলেনিতো কোন আলেম ব্যক্তিত্ব,- তাহলে আজকের কথিত আলেমগন শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য অপসারণের ঘোষণা দিয়ে তারা যা প্রমান করলেন, তাহচ্ছে বাঙালি আর বাংলাদেশের ঐতিহ্যের প্রতীক মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকে মুছে ফেলা।
তাই এটি নিঃসন্দেহে একটি রাজনৈতিক অভিলাষী কর্মকান্ডকেই সমর্থন করছে। যেহেতু বর্তমান বাংলাদেশের রাজনীনিতিতে দৃশ্যতঃ বিরোধী দল অপরিনত এবং অদৃশ্য – সেহেতু মধ্যবর্তী শক্তিকে পুজি করে যারা রাজনৈতিক ফায়দা লুটবার চেষ্টায় লিপ্ত –তাদের ইতিহাসের ধারস্ত হয়ে শিক্ষা নিতে হবে যে,–রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের ব্যবহার কোনদিন এই অঞ্চলে সফলতার মুখ দেখনি।এক্ষেত্রে ৪৭ সালের সাম্প্রদায়িকতায় ভারত বিভক্তির সুচনা থেকে -৫২সালে অসম্প্রাদায়িকতার ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই সমাপ্তির সুচনাটিই এর জলন্ত দৃষ্টান্ত।
একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ যখন সকল পথ পরিক্রমার অবসান ঘটিয়ে স্বপ্নের সোনার বাংলাকে বাস্তবে রুপান্তরিত করছে -তখন ঐতিহ্য আর ঐক্যের প্রতীক বাঙালি জাতির আদর্শিক চিন্তার সৃজনশীল ভাস্কর্য –বাংলা আর বাঙালির শ্রেষ্ট আবেগ বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের প্রতি এতটা আঘাত নিঃসন্দেহে -আরেকটি অপরিনত সিদ্বান্তকেই দৃশ্যমান করলো। বঙ্গবন্ধুর প্রতি এতটা অবিচারে রাষ্ট্র আর সরকারকে যতটা না ব্যতিত করছে তার চেয়েও বেশী অস্থির করে তুলছে বাঙালি জাতিকে।
রাষ্ট্র্র ক্ষমতার মোহে যে কোন রাজনৈতিক সংগঠন ক্ষমতাসীন সরকারের বিরোধী অবস্থান কাম্য হতে পারে, কিন্তুুু বাঙালি জাতির মুক্তিদাতা স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধুর প্রতি এতটা অশোভনতা কতটা রাষ্ট্রদ্রোহিতা সেটা রাষ্ট্রকেই হিসাব করতে হবে। নবাব সিরাজ থেকে–জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ষড়যন্ত্র কারীদের তাৎক্ষণিক বিচারকার্যের অবহেলা আর কালক্ষেপনে বাংলাকে হারাতে হযেছে এই সমস্ত মহান দেশপ্রেমিকদের।
আজ নুরু, তাহেরি, মামুনুল সাহেবরা যে ভাষায় রাষ্ট্র এবং সরকারকে চ্যালেন্জ করে বক্তৃতায় মাঠ গরম করছেন- তাতে জাতি বিব্রত। মনে রাখতে হবে, অনেক পথ অতিক্রম করে জাতিকে জানতে হয়েছিলো কুকুরের মাথায় কারা টুপি পড়িয়েছিলো প্রমানীত হয়েছিলো ক্ষমতার বদল হলেও মসজিদ থেকে সুমধুর আজানের পরিবর্তন হয়নি,এটি কোন দেশের অঙ্গ রাজ্যেও পরিনত হয়নি।
কিন্তু আজকের এই প্রবাহমান ঐতিহ্যের প্রতি চ্যালেন্জের মুল অর্ন্তনিহিত কারন বাঙালির বুঝতে খুব বেশি সময় ক্ষেপন হবে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নীলকন্ঠ উনি বিষ হজম করতে পারেন কিন্তু এদেশের মানুষ জাতির পিতার অসম্মানে ব্যতিত হৃদয়ে রাষ্ট্রের কাছে সমুচিত বিচারের নিশ্চয়তা চায়।
এর দায় সরকারকে নিতেই হবে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে যারা রাজনীতির মাঠে ধর্ম ব্যবহারকারী তারাই স্বাধীনতা ও সার্বভৌত্বের জন্য হুমকি স্বরুপ। সুতারাং তাদেরকে নিয়ে রাজনীতি না করে দেশের স্বার্থে দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন অপরিহার্য।
লেখকঃ মোঃ এমদাদুল হক বাবুল, প্রভাষক,ইতিহাস বিভাগ,পূর্বধলা সরকারি কলেজ, পূর্বধলা-নেত্রকোনা।