দুর্গাপুর(নেত্রকোনা)প্রতিনিধি : জেলার দুর্গাপুরে মেঘালয়ের পূর্ব অংশে সু-সঙ্গ নামে এক পরগনার গোড়াপত্তন শুরু হয়। সোমেশ্বর পাঠক ভারতের কান্যকুব্জ থেকে ১২৮০ খৃষ্টাব্দ পূর্ব ময়মনসিংহের উত্তরভাগ ‘পাহাড় মুল্লুকে’ সঙ্গীসাথী নিয়ে কামরূপ ভ্রমণের লক্ষ্যে দুর্গাপুরের স্থানীয় দশভূজা বাড়ির প্রাঙ্গনে বিশ্রামের জন্য যাত্রাবিরতি কালে অত্র এলাকার এক অত্যাচারী গাড়ো রাজা কে যুদ্ধে পরাস্ত করে সু-সঙ্গ অর্থাৎ ভাল সঙ্গ নামে এক রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন সোমেশ্বর পাঠক। আর সে থেকেই সুসঙ্গ রাজবংশের আদি পুরুষ হিসেবে সোমেশ^র পাঠককেকই মানা হয়। ঐতিহাসিক সুসঙ্গ রাজ পরিবারের ইতিহাস রক্ষনাবেক্ষনের অভাবে বর্তমানে বিলুপ্তির পথে।
এ নিয়ে বৃহস্পতিবার ঐতিহ্যবাহী সুসঙ্গ রাজ পরিবারের নানা স্থাপনা পরিদর্শন করা হয়। এ বিষয়ে কবি আবুল বাশার বলেন, রাজবংশের যোগ্য উত্তরসূরী মল্লযোদ্ধা রাজা রঘুনাথ সিংহ মোঘল স¤্রাট আকবরের সিংহাসন আরোহনের পর তাঁর সাথে এক চুক্তি করেন। এই চুক্তির অংশ হিসেবে রাজা রঘুনাথ সিংহকে মানসিংহ এর পক্ষে বিক্রমপুরের চাঁদ রায়, কোদার রায় এর বিপক্ষে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতে হয়। যুদ্ধে চাঁদ রায়, কেদার রায় পরাস্ত হলে রাজা রঘুনাথ সেখান থেকে অষ্ট ধাতুর এক দুর্গা প্রতিমা নিয়ে আসেন এবং রাজ মন্দিরে স্থাপন করেন যা আজো দশভূজা মন্দির নামে সুপরিচিত। তখন থেকেই সু-সঙ্গের সাথে দুর্গাপুর যোগ করে এই অঞ্চলের নামকরণ হয় সুসঙ্গ দুর্গাপুর। এক সময় দুর্গাপুর ছিল সুসং রাজ্যের রাজধানী। ৩ হাজার ৩শ’ ৫৯ বর্গমাইল এলাকা ও প্রায় সাড়ে ৯শ’ গ্রাম নিয়ে প্রতিষ্ঠিত সুসং রাজ্যের রাজধানী ছিল দুর্গাপুর। বর্তমানে এটি নেত্রকোনা জেলার একটি উপজেলা। সোমেশ্বর পাঠক থেকে শুরু করে তাঁর পরবর্তী বংশধররা প্রায় ৬৬৭ বছর শাসন করেন এ রাজ্য। কিন্তু রাজকৃষ্ণ নামে এক রাজার শাসনামল থেকে সুসং রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে রাজপরিবারে বিরোধের সূত্রপাত হয়। ফলে এক সময় গোটা রাজ্য চারটি হিস্যায় ভাগ হয়ে চারটি পৃথক রাজবাড়ি প্রতিষ্ঠিত হয়। ‘বড় বাড়ি’, ‘মধ্যম বাড়ি’, ‘আবু বাড়ি’ ও ‘দু’আনি বাড়ি’ নামে পরিচিত ছিল। ‘৪৭-এর দেশ বিভাগ এবং পরবর্তীতে ‘৫৪ সালে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ আইন পাস হবার পর রাজবংশের সদস্যরা ভারতে চলে যান। আর এর মধ্য দিয়েই অবসান ঘটে সুসং রাজ্যের।
বর্তমানে সুসং রাজবাড়িটিতে ১৯৭০ সনে স্থাপিত হয় সুসঙ্গ কলেজ। রাজবাড়ির অভ্যন্তরে ছিল সৈনিকদের আবাস, বিচারালয়, কারাগৃহ, অস্ত্রাগার, চিড়িয়াখানা, হাতিশালা, রাজপরিবারের সদস্যদের প্রাসাদ, শয়নকক্ষ, কাচারি ঘর, বৈঠকখানা ইত্যাদি। ১৩০৪ খ্রিস্টাব্দের ভয়াবহ ভূমিকম্পে সুসং রাজ্যের রাজা জগতকৃষ্ণ সিংহ প্রাচীর চাপা পড়ে নিহত হন এবং রাজবাড়ির ব্যাপক ক্ষতি হয়। বর্তমানে যে নিদর্শনগুলো টিকে আছে তার অধিকাংশই জগতকৃষ্ণের পরবর্তী বংশধরদের নির্মিত। একটি পানির ইঁন্দারা ও সীমানা প্রাচীর ছাড়া বড় বাড়ির কোন স্মৃতিচিহ্ন নেই এখন। ‘মধ্যম বাড়ি’র বাইরের পূর্ব দিকের একটি ঘর এখন দুর্গাপুর সদর ইউনিয়ন ভূমি অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এ বাড়ির কাচারি ঘরগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে দুর্গাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় হিসেবে। ১৯৬৯ সালে মধ্যম বাড়ির অভ্যন্তরের কয়েকটি ঘর নিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয় দুর্গাপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়। এর মধ্যে দক্ষিণ পাশের একটি ঘর (রাজাদের বাসগৃহ) প্রধান শিক্ষকের কার্যালয়, উত্তর দিকের ঘরটি (রাজাদের বাসগৃহ) বিদ্যালয়ের শ্রেণীকক্ষ এবং দক্ষিণ-পূর্ব দিকের ঘরটি এখনও শিক্ষক-শিক্ষিকার মিলনায়তন হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। পাশে^ই মহিলা ডিগ্রি কলেজ এ রয়েছে বড় ইন্দেরা, যে পানি দিয়ে স্নান করতেন মহারানী। এ কলেজের সামনেই আছে একটি পুকুর যা এখনও ‘রাজবাড়ির বড় পুকুর’ নামে পরিচিত। ‘আবু বাড়ি’তে স্বাধীনতার চার-পাঁচ বছর আগেও অমরেন্দ্র সিংহ শর্মা নামে সুসঙ্গ রাজবংশের এক সদস্য বসবাস করতেন। এলাকায় তিনি ‘মিনি বাহাদুর’ নামে পরিচিত ছিলেন। তাঁর দেশত্যাগের পর ওই বাড়ির কয়েকটি ঘর বিভিন্ন সময় সরকারী কর্মকর্তাদের বাসাবাড়ি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ওই ঘরটি এখন প্রায় পরিত্যক্ত। এর ভেতর বাড়ির পেছনের ঘরটিতে ১৯৮৭ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় ‘সুসঙ্গ আদর্শ বিদ্যানিকেতন’ নামের একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
এদিকে, দু’আনি বাড়ির অনেক স্মৃতিচিহ্ন এখনও অক্ষত আছে। বর্তমানে ওই বাড়িতে বসবাস করছেন গোপাল দাস নামে এক ব্যক্তি। তিনি রাজবাড়ির সাবেক কর্মচারী সাধুচরণ দাসের পৌত্র। এ বাড়ির সামনের ঘর (যেখানে মহারাজা বসবাস করতেন) পুজোমন্ডপ ও পানির ইন্দারা আজও রাজবংশের স্মৃতি বহন করে চলেছে। পুজোমন্ডপটি ‘নিত্যপূজামন্ডপ’ হিসেবে পরিচিত। সেখানে আশ্বিন মাসে দুর্গাপুজো ছাড়াও সারা বছর বিভিন্ন ধর্মীয় পুজো-পার্বণ হয়। কাঠের তৈরি এ ঘরগুলোর নির্মাণশৈলীও বেশ নান্দনিক। এছাড়া কমল রানীর দীঘি, কমরেড মনি সিংহের স্মৃতি সৌধ, হাজং মাতা রাশী মনি এর স্মৃতি সৌধ, চন্ডিগড় অনাথ আশ্রম, বিরিশিরি ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর কালচারাল একাডেমী, রানী খং ধম্মপল্লী, সাদা মাটির পাহাড় তো রয়েছেই।
এছাড়াও দুর্গাপুরের সুসঙ্গ রাজাদের স্মৃতিচিহ্নকে আজও ধরে রেখেছে ১৯১৮ সালে স্থাপিত মহারাজা কুমুদচন্দ্র মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয়, দশভুজা মন্দির (যেখানে সোমেশ্বর পাঠক প্রথম ধর্মীয় উপসনালয় স্থাপন করেছিলেন) ও রাজবাড়ির এক ম্যানেজারের বাসভবন। এছাড়া রয়েছে ওই সময়ে প্রতিষ্ঠিত কুমার দ্বিজেন্দ্র পাবলিক লাইব্রেরী। যা কিনা বৃহত্তর ময়মনসিংহের অভিধান হিসেবে খ্যাত। মহিলা ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ ফারুক আহমেদ তালুকদার বলেন, যে সকল এলাকায় আদি পুরোকৃত্তি রয়েছে, ঐসব এলাকায় তাঁর ঐতিহ্য তুলে ধরে। ঐতিহ্যবাহী সুসঙ্গ রাজ পরিবারের ইতিহাস রক্ষায় এলাকার সকলেই এগিয়ে আসা উচিত।
এ নিয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফারজানা খানম বলেন, আমি এলাকায় সদ্য যোগদান করেছি। এলাকার দর্শনীয় স্থান গুলো এখনো ঘুরে দেখতে পারিনি। ইতিহাস ঐতিহ্য লালন করতে উপজেলা প্রসাশন থেকে যতটুকু সহায়তা করার আমি করবো। এ জন্য সকলকে এগিয়ে আসতে আহবান জানান।